ধামশ্রেণী ঐতিহাসিক ভাবেই গুরুত্বপুর্ন। ধামশ্রেণীর ১ নং ওয়ার্ড ধামশ্রেণী ঠাকুড়বাড়ির আছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ৩২০ বৎসর পুরাতন একটি মন্দির এই এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এটি এ এলাকার পর্যটন কেন্দ্র ও সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসেবে দুর দুরান্তের দর্শনার্থী ও পর্যটকদের আকর্ষনীয় স্থান হতে পারতো। দর্শনার্থীদের আগমনের জন্য যথেষ্ঠ সম্ভাবনাময় এ এলাকা সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও দিক নির্দেশনার অভাবে সরকারের সুনজরে না পরায় ধীরে ধীরে মন্দিরের পুরো স্থাপনা ও অবশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো ভগ্নদশায় পরিনত হতে চলেছে।চন্ডিমন্দির সিদ্ধেশ্বরী কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা সদর থেকে ৩ কিমি পূর্বদিকে ধামশ্রেণী নামক স্থানে অবস্থিত । মন্দিরটি মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭) নির্মিত বলে একাধিক ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় । মন্দিরটি দেখতে অনেকটা কালীমন্দিরের ন্যায় । ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পে এটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ।এখানে নতুন একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে । এখানেই ছিল বাহারবন্দ পরগণার সদর দফতর এবং জমিদার ছিলেন রাণী সত্যবর্তী । ধামশ্রেণীতে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির নামে আরেকটি মন্দির অবস্থিত। প্রসিদ্ধ আরও একটি দোলমঞ্চ মন্দির যা ধ্বংসপ্রাপ্ত এ মন্দিরটিরও অবস্থান এখানে ।
জমিদার রাণী সত্যবর্তীর (১৬৫৮-১৭৮৭খ্রি.) নিযুক্ত ব্রাহ্মণ পুরোহিতের গৃহ প্রাঙ্গণে স্থাপিত এই মন্দিরটি এখন ভগ্নদশাপ্রাপ্ত । এ স্থানে আরো কয়েকটি মন্দির আছে, ভৈরব মন্দির, এ মন্দিরের নতুন করে স্থাপনার কাজ শুরু হলেও নির্মান কাজ শেষ হয়নি। শিব মন্দিরটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উল্লেখযোগ্য হলেও এটিও ভগ্নদশা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। অবশ্য মুল মন্দির প্রাঙ্গনে শিব মন্দির পরবর্তী সময় তৈরি করেছে মন্দির কমিটি। রানী সত্যবতীর হাতে তৈরি স্থাপনাগুলো যা (১৬৫৮- ১৭০৭ খৃীঃ) সময়কালে নির্মিত ছিলো তা ১৮৯৭’র ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রসহ হয় মন্দির সহ এখানকার স্থাপনাগুলো। উজ্জল কুমার ভট্টাচার্য পিতা- স্বর্গীয় সজল কুমার ভট্টাচার্য মাতা- স্বর্গীয় সাবিত্রী রানী ভট্টাচার্য । কথা হয় উজ্জল কুমার এর সাথে, বাবা মারা যাওয়ার পর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন। গত ৩ মাস পূর্বে এই পুরোহিতের শুভবিবাহ সম্পন্ন হয় উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের হাবলু সরকারের মেয়ে তিথীরানী সরকারের সাথে। তিথীরানী সরকার ছিলেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ( প্রতিবন্ধি) মেয়ে। তিথীরানীর চিকিৎসার সুবাদে রংপুর রেব্জের মাননীয় ডিআইজি জনাব দেবদাস ভট্টাচার্য তিথীর বিয়ের অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন।প্রতিবেদকের সাথে সেই সুবাদে কথা হয় উজ্জল কুমার ভট্টাচার্যের। তিনি জানান এই মন্দিরে আরও ৩ জন পুরোহিত আছেন তারা হলেন বলাই কিশোর ভট্টাচার্য ও মিলন কুমার ভট্টাচার্য এবং মিনতি দে। কথা হয় তাদের সাথেও মন্দির ও তাদের ব্যাক্তি জীবনযাপন নিয়ে। উজ্জল কুমার ভট্টাচার্যের নিজস্ব কোন থাকার জায়গা নাই, তিনি মন্দির কমিটির সভাপতির বাবা স্বর্গীয় টোরা ঠাকুর এর বাড়িতেই বাবার আমল থেকে বসবাস করে আসছেন। চারজন পুরোহিতের জীবনযাপনে অভাব অনটন লেগেই আছে। মন্দিরের যা আয় সেখান থেকে তাদের মাসিক সম্মানী দেয়া হয় বলে জানান উজ্জল কুমার ভট্টাচার্য।
সরেজমিন ঘুরে ফিরে স্থানীয় লোকজনদের সাথে কথা হয়, তাদের দেয়া তথ্যমতে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে দেবত্বের জায়গা আছে ১৪ একর ৬২ শতক। মন্দিরের মাঠ ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবে একসময় প্রসিদ্ধ ও ক্রীড়াচর্চার জন্য সুখ্যাতি ছিলো। মাঠের বিপরীতে আছে এক বিশাল পুকুর, যা চাপাতলা পুকুর বলে আখ্যায়িত হলেও স্থানীয়রা পুকুর ভোগ দখল কারী দের ব্যঙ্গ করে চামারতলা পুকুর নামেও ডাকে। আনুমানিক ৩ একরেরও বেশী জায়গা নিয়ে পুকুরটির মধ্যে মাছ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। পদ্মতলা পুকুর নামে মন্দির সংলগ্ন আরও একটি দেড় একর জায়গা জুরে পুকুর রয়েছে।। যুগযুগান্তর ধরে একটি শ্রেনী পুকুরটি ভোগদখল করে আসলেও নিকট অতীতে তা বাৎসরিক লিজের মাধ্যমে বন্দোবস্ত দেয়া হয় বলে জানা যায়। একই সময় প্রায় ৫ বছর আগে দেবত্বের কিছু জায়গা দখলমুক্ত করে মন্দিরের পক্ষ থেকে ৪০ টির মত দোকান ঘর তৈরি করে জামানত ও মাসিক ভাড়া নিয়মে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়েছে। দোকানের আকার আয়োতন হিসেবে প্রতিটি ১৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়, যা দিয়ে মন্দিরের ব্যায় মিটানো কষ্টকর বলে জানা গেছে। প্রতিবছর এতদাঞ্চলের বিখ্যাত বৈশাখ মাসের সিদ্ধেশ্বরী নামক মেলা এলাকার অন্যতম একটি মিলন মেলা। এ মেলাকে ঘিরে বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, সার্কাস,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যাত্রা পালা হলেও মন্দির কমিটির ফান্ডে তেমন কোন টাকা জমা হয় না যা দিয়ে উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজ করা সম্ভব, এমন কথা জানান এই সিদ্ধেশ্বরী মন্দীর কমিটির সাঃসম্পাদক ভোজন কুমার পাল । দর্শনার্থী ও দাতাদের মন্দির উন্নয়নে ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে উপঢৌকনাদি ও নগদ অর্থ আগে একসময় আসলেও এখন তা শূন্যের কোঠায় বলে জানান তিনি।
এ মন্দির সংলগ্ন এলাকাটি পাল সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য ও আধিক্য রয়েছে। ঠাকুড়বাড়ি সংলগ্ন এলাকাটি পালপাড়া নামে পরিচিত। এ পাড়াতেই বাঙ্গালী সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব শারদীয় দূর্গাপুজা উদযাপনে কয়েকটি মন্দিরে সাজসাজ রব ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে দেবী দূর্গার পূজা অর্চনা করা হয়। ঠাকুড়বাড়ির সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরে দেবী দূর্গার একসময় পূজা অর্চনা তথা শারদীয় দূর্গাৎসব হতো। দেবী দূর্গার জন্য নির্দিষ্ট মন্দির থাকার কথা জানান এখানকার পুরোহিত।হালের বিবর্তনে সেই মন্দির এখন পুজা অর্চনা , দর্শনার্থী আগমন, হিন্দু মুসলিমদের মিলনমেলা সহ সকল ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অবয়ব থেকে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। নিয়মানুযায়ী মন্দিরে প্রতিদিনই পূজা অর্চনা করা হয় তবে দর্শনার্থী ও উৎসব মূখর পরিবেশের কেন্দ্রভূমি অতীতের মত আর নেই।একদা যে ঠাকুর বাড়ী কে ঘিরে খেলাধূলা,সাংস্কৃতিক চর্চা,জ্ঞানচর্চা, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়েছিলো তা এখন মৃত এলাকায় পরিনত হতে চলেছে। মন্দির কে ঘিরে যে বাজারটি গড়ে উঠেছিলো সেই বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিন দিন লোকসানে পরে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার অবস্থায় পরেছে।
এলাকাবাসীদের মতে, দেবত্বের জায়গার উপর যেহেতু মন্দির কর্তৃপক্ষের মুল নিয়ন্ত্রন আছে ফলে মন্দিরকে তার স্বরুপে ফিরিয়ে আনতে এ স্থানটিকে সময়োপযোগী করে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের আনতে বেশকিছু সংস্কারমূলক কাজ করা জরুরী বলে মনে করেন । বাহারবন্দ পরগনার সদর দফতর হিসেবে রানী সত্যবতীর ইতিহাস ঐতিহ্যের এক নিদর্শন এই ঠাকুড়বাড়ি। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মতে, সরকারের সুনজর ও সংস্কার মুলক পদক্ষেপ এ মন্দিরের জন্য গ্রহন করলে ঠাকুড়বাড়ি ফিরে যাবে তার অতীত রুপ ও সৌন্দর্যে।বিশাল মাঠ, পুকুরের চতুর্দিকে চওড়া পাড়, মন্দিরের ভিতরে বাহিরে প্রচুর জায়গা। অতীতে অনেক জানা অজানা বিশালাকার গাছ ঠাকুড়বাড়ির শোভাবর্ধন করতো। গাছগুলি নাই, অথচ সে সকল ফাকা জায়গায় গত ১০ বছরের মধ্যে নেয়া হয়নি সবুজ বনায়ন করার কার্যকর কোন ব্যবস্থা। মন্দিরের প্রধান ফটকের পাশে দর্শনার্থী দের বসার যে পাকা বেঞ্চ করা হয়েছে সেগুলোও অসমাপ্ত ও ধূলোময়লায় আবর্জনায় বসার অনুপযোগী। মন্দিরের সাইনবোর্ড, চতুর্দিকের ওয়াল, মন্দিরের ঘড় ও উপসনালয় গুলো সংস্কার ও মেরামতের অভাবে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পরে আছে।শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের দায়িত্বরত ব্যাক্তিবর্গ নয় স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীদের এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতা অবহেলায় পুরাতন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে অবশিষ্ট যা আছে সেগুলো ধ্বংসের দারপ্রান্তে। সবুজ বনায়ন ও বৃক্ষরোপন কর্মসূচী হাতে নেয়া হলেও এলাকাবাসীর সচেতনতার অভাবে গবাদীপশু কর্তৃক তা নষ্ট হওয়ার যথেষ্ঠ উদাহরন আছে বলেও দাবী মন্দির কমিটির সাঃসম্পাদক ভোজন কুমার পালের।এগুলো রক্ষায় করনীয় কি এবং মন্দির উন্নয়ন ও সংস্কারে কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারে এ বিষয়ে জেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে আশার আলো দেখান। তিনি বলেন, সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে মন্দির উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সে দিক থেকে জেলা সদর অগ্রাধিকার পেলেও কুড়িগ্রাম সদরের মন্দিরগুলোর প্রয়োজনীয় জায়গা নেই। যা উলিপুরের ২ টি মন্দির বিশেষ অগ্রাধিকার পায়, একটা উলিপুর সদরে গোবিন্দ মন্দির অপরটি ধামশ্রেণীর ঐতিহাসিক রানী সত্যবতীর সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। ধামশ্রেণীর এই মন্দিরটির দেবত্বের বিশাল জায়গা পরে আছে। উনি আরও বলেন গত চারমাস আগে জুনে কুড়িগ্রামের নদ- নদী নিয়ে দুপাড় বাধাসহ পর্যটন কেন্দ্র করে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা তা নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয় হল রুমে মাননীয় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভায় ধামশ্রেনির মত ঐতিহাসিক স্থানগুলো কে পর্যটন কেন্দ্র করে গড়ে তোলার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। আমরা চেষ্ঠা করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে মন্দির উন্নয়ন ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার বাজেট টি ধামশ্রেণীর সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের জন্য বরাদ্দ টি নিশ্চিত করা যায়।ধামশ্রেণী ঠাকুরবাড়ি মন্দির কমিটির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক মলয় কুমার ভট্টাচার্য রংপুরে অবস্থান করার কারনে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।উল্লেখ্য ধামশ্রেণীর সিদ্ধেশ্বরী মন্দির কে ঘিরে অত্র এলাকার হিন্দু-মুসলিম মানুষদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও কৃষ্টি কালচার এবং ঐতিহ্যের ধারাকে একসাথে ধারন করে বয়ে নিয়ে আসার সুন্দর উদাহরন রয়েছে। অতীত ঐতিহ্য কে ধারন করে মিলন মেলার এ রুপ সৌন্দর্য কে অন্য এলাকার জন্য উদাহরন সৃষ্টিতে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির অন্যতম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্র ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের তীর্থস্থান হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সরকারের কাছে জোড় দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।বাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য কীর্তিগুলির মধ্যে মন্দিরসমূহই শ্রেণিগতভাবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে এগুলির মাত্র কয়েকটিই দেখা যায়। এই সীমিত সংখ্যা স্থানীয় মন্দির স্থাপত্যের ধারাবাহিক ও অর্থবহ বিবরণ রচনার পথে কষ্টকর। তাই এগুলো সংরক্ষনে সরকারের নিকট দৃষ্টি আকর্ষন করা সকলের দায়িত্ব।
Leave a Reply